মহাবিশ্বে প্রাণ
এই মহাবিশ্বে ,পৃথিবীর বাইরে কি প্রাণ আছে ? মার্কিন স্থপতি, উদ্ভাবক এবং
ভবিষ্যৎ বক্তা বাকমিন্সটার ফুলার একটি কথা বলেছিলেন যে “ এই পৃথিবীর বাইরে প্রাণ
আছে বা নেই । উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের কাছে তার তাৎপর্য অপরিসীম”।
অন্তত পক্ষে যবে থেকে মানুষ জানতে
পারে যে পৃথিবীর বাইরেও একটা জগত আছে তবে থেকে মানুষের মনকে সুদূর এই প্রশ্নের
সম্মুখে দাঁড় করিয়েছে । এ প্রশ্নের একেবারে প্রামান্য উত্তর আজো মেলেনি, কিন্তু
আমরা এই যুগে দাঁড়িয়ে বোধহয় এর কিছুটা উত্তর পেতে চলেছি ।
সভ্যতার বিকাশ
বিজ্ঞান আমাদের অনেক কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছে এবং আর কিছুর উত্তর শীঘ্র
দিতে চলেছে। প্রাণ জন্মাতে গেলে কয়েকটি প্রাথমিক শর্ত আছে। প্রথম শর্ত
পৃথিবী এবং সৌরজগতের বাইরে গ্রহের অবস্থিতি, কারন নক্ষত্রে তার অত্যন্ত বেশি
তাপমাত্রার জন্যে প্রাণ থাকা অসম্ভব। আমরা জানতে পেরেছি যখন নক্ষত্ররা জন্মায় তখন
তার চারপাশে যে সমস্ত গ্যাস ও ধূলিকনা মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটেশনের ফলে জমে জমে
ক্রমশ প্রথমে আস্টিরয়েড বা গ্রহাণু ও পরে গ্রহে পরিনত হয় । বৈজ্ঞানিক পয্য‾বেক্ষণের ফলে
জানা গেছে যে এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ এবং বহুঘটিত ব্যাপার । যদিও নতুন তথ্য
যা জানা গেছে তাতে এটাই যে একমাত্র গ্রহের জন্মের উপায় তা নাও হতে পারে । এখন
পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে এই মহাবিশ্বে অকল্পনীয় সংখ্যক গ্রহের অবস্থিতিই
সম্ভাব্য ঘটনা।
গ্রহের উৎপত্তি
দ্বিতীয়ত প্রাণ যে ভাবে আমরা পৃথিবীতে জানি তা থাকতে গেলে সেই গ্রহে
কার্বন ও জল থাকতে হবে । যা জানা গেছে এই দুটোই এই ব্রহ্মান্ডে বহুল পরিমাণে আছে।
কার্বন তৈরি হয় তারার মধ্যে পারমানবিক গলন বা নিউক্লিয়ার ফিউসনের জন্যে। অনেক
নক্ষত্রের মৃত্যুকালে সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় তা মহাজাগতিক শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে।
আমাদের পৃথিবীতে যে কার্বন আছে তা অনেক তারার জন্ম ও মৃত্যুর শেষে পৃথিবীতে
পৌঁছেছে। আমাদের দেহ মূলত কার্বন দিয়ে গঠিত এবং দেহের প্রত্যেকটি
কার্বন পরমাণুর ইতিহাস আলাদা, তার জন্ম কোটি কোটি ভিন্ন তারার কন্দরে। এই
ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে একটি মহা বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং এর
সুত্রে (যদিও এই মতবাদ যে সম্পূর্ণ প্রমানিত তা বলা যায় না)। যত সময় গেছে তত
বেশি তারার জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে অর্থাৎ যত সময় গেছে তত বেশি কার্বন পরমাণুর সৃষ্টি
হয়েছে। অর্থাৎ বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্ব আরো প্রাণের উপযুক্ত হয়েছে। আমাদের
পৃথিবীতে প্রাণকে যেভাবে জানি তার সংজ্ঞা হল একই জেনেটিক কোড বা ডি.এন.এ বা
ডি-অক্সিরিবনিউক্লেইক অ্যাসিডের উপস্থিতি। এটি ব্যতীত প্রাণের প্রাথমিক সেল গুলি
নিজেকে পুনঃ প্রজনন ও বিভাজন করতে পারেনা যা জীবনের সংজ্ঞা।
মহাবিশ্বে কার্বনের প্রতুলতা
ডি. এন. এ
কিন্তু যখন আমরা পৃথিবীর বাইরে প্রানের কথা ভাবছি তখন এই সম্ভাবনার কথা
মনে রাখতে হবে যে এমন প্রাণও থাকতে পারে
যার প্রাথমিক মূল আধার কার্বন এবং জল নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত কার্বন এমন কোনো প্রাণের প্রাথমিক বস্তু কণা করতে সক্ষম
করতে পারে যা হয়তো ডি.এন. এ নয়। আর একটি তৃ্তীয় সম্ভাবনার কথা মনে রাখতে হবে।
কম্পিউটার এবং কম্পিউটার চালিত রোবট এর যান্ত্রিক বুদ্ধি ক্রমশ বেড়ে চলেছে অত্যন্ত
প্রচণ্ড গতিতে। এখনকার স্মার্ট ফোন যা অনেকেরি এখন পকেটে থাকে তার ক্ষমতা প্রথম
তৈরি কম্পিউটার (১৯৪৬ সালে) “এনিয়াক” এর চেয়ে ৫০ গূন বেশি। এনিয়াক একটি বড়
বাড়ির সমান বড় ছিল (১৮০০ স্কোয়ার ফিট বা ১৬৭ স্কোয়ার মিটার)। মূর’স ল অনুযায়ী
আগামি কুড়ি ত্রিশ (এটা ২০১৩ সাল) বছরের মধ্যে কম্পিউটার ও রোবটের বুদ্ধি মানুষের
বুদ্ধির সমান হয়ে যাবে। সেই রোবটের প্রাণীর মত আচরণ করার এবং পরিশেষে প্রাণীর মত
প্রজনন সক্ষম হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং একটি সময় আসবে যে এইসব রোবট
গুলিও প্রাণী আখ্যা পাবে। সুতরাং মহাবিশ্বে প্রাণের কথা ভাবলে এই সব সম্ভাবনা
গুলিও মনে রাখতে হবে।
এনিয়াক
স্মার্ট ফোন
যদি আমরা পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাস দেখি , দেখা যায় প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে
পৃথিবীর জন্মের অল্প কিছু পরেই, প্রায় ১০০ কোটি বছর পরে (পৃথিবীর বয়েস প্রায় ৪৬০
কোটি বছর)। এই সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রাণের পক্ষে অত্যন্ত বিপদ সঙ্কুল ছিল। নানা
রকম বিষাক্ত গ্যাস , মারাত্মক অগ্ন্যূৎপাত, এবং মহাকাশ থেকে প্রতিনিয়ত আশা বিশাল
বিশাল উল্কা পাত প্রাণের পক্ষে অত্যন্ত প্রতিকূল ছিল। কিন্তু তা সত্তেও পৃথিবীতে
প্রান এসেছে খুব শীঘ্র।
দ্বিতীয় তথ্য , যা আগেই বলেছি, তা হল যে এই মহাবিশ্বে প্রাণের মূল উপাদান
কার্বন ও জল বহুল পরিমানে সুলভ।
তৃতীয়ত এও দেখা গেছে যে যখন প্রাণের মৌলিক উপাদান গুলি একসঙ্গে থাকে তখন
খুব সহজেই প্রাণের সৃষ্টি হয়। এটা কি করে সম্ভব হয় তা অবশ্য আমরা এখনও পুরোপুরি
জানিনা। ল্যাবরেটোরিতে এখনও পর্যন্ত একটি জীবন্ত প্রাণ কোষ এর জন্ম দেওয়া সম্ভব
হয়নি যদিও কোষ সৃষ্টির কিছু ধাপ পরীক্ষাগারে সম্পন্ন করা গেছে। পরীক্ষাগারে প্রাণ
সৃষ্টি কোনদিন পুরোপুরি করা যাবে কিনা জানিনা কিন্তু এটুকু নিশ্চিত প্রকৃতিতে
প্রাণের মৌলিক উপাদান গুলি সহজেই মিলে মিশে প্রাণের সৃষ্টি করে।
চতুর্থত এটা দেখা যায় প্রাণ পৃথিবীতে প্রায় যে কোনো প্রাকৃতিক অবস্থায়
উৎপন্ন হয়। আমাদের অর্থাৎ মানুষকে বাঁচবার জন্যে সাধারণত মৃদু ধরনের প্রকৃতির
দরকার হয় অর্থাৎ খুব বেশি বা কম তাপমাত্রা, প্রতিকূল বাতাবরন বা খুব বেশি বা কম
চাপ আমরা সহ্য করতে পারিনা। আমাদের বাঁচবার জন্যে সূর্যালোকেরও খুব প্রয়োজন।
কিন্তু এ পৃথিবীতে এমন প্রাণী আছে বিশেষত বহু অণুজীব (microbes) যে গুলো অনেক বেশি
প্রতিকুল অবস্থা সহ্য করতে পারে। এমন অণুজীব আছে যা যেখানে ১০০ বছর বৃষ্টি হয় নি,
যেখানে অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাস বা পদার্থ রয়েছে, যেখানে প্রচণ্ড বেশি বা কম চাপ
(১০০০ গুন), যেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ অত্যন্ত বেশি এবং যেখানে কোনো দিন সূর্যালোক
পৌঁছয় না সেই সব জায়গাতে খুব স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং আমাদের সাধারন
ধারনায় যা আসে তার চেয়ে বহু বহু গুণ প্রতিকূল অবস্থাতে প্রাণ বেঁচে থাকতে পারে।
অত্যন্ত বেশি তাপে প্রাণ
|
অত্যন্ত বেশি তেজস্ক্রিয় বিকিরণে প্রাণ |
খনির অন্ধকারে একাকি প্রাণ
অত্যন্ত বিষাক্ত পরিবেষে প্রাণ
অত্যন্ত ঠাণ্ডায় প্রাণ
পঞ্চমত এই মহাবিশ্বে যেসব জায়গাতে
প্রাণ বাঁচতে পারে (এমনকি মানুষের মত প্রাণ বাঁচতে পারে) তার সংখ্যা অগণ্য।
সুতরাং প্রাণ থাকার সব কটি উপকরনই এই ব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে।
মহাবিশ্বে প্রাণ থাকার কারণ
এবার দেখা যাক এই সৌরজগতে প্রাণের কোনো আভাষ আমরা পাচ্ছি কিনা। আমাদের কাছের যে
গ্রহ আমাদের এই ব্যাপারে সবচেয়ে প্রলুব্ধ করে তা হল মঙ্গল। দূরবীক্ষণের সাহায্যে
এবং মঙ্গলে অভিযান চালিয়ে যা দেখা গেছে তাতে জানা গেছে মঙ্গলের ভূস্তর মরুভূমি। এক
সময় আজ থেকে ২০০-৩০০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের উপরিভাগে জল ছিল যা অনেক আগেই বিলীন হয়ে
গেছে। সুতরাং মঙ্গলের ওপরে যদিও বা প্রাণী থাকে তা অণূজীবের রূপে মাটির তলায়।
কিন্তু মঙ্গলে একটি অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। মঙ্গলের তোলা
ছবি থেকে এটা স্পষ্ট যে মঙ্গলের ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই উল্লেখযোগ্য পরিমানে জল
মাটির বাইরে উঠে আসে। অর্থাৎ মঙ্গলের মাটির নিচে
জল আছে। কত নিচে আছে, ৫,১০,১৫ বা ১০০ মিটার তা আমরা জানিনা। এবং এই জল ওপর
থেকে মাটির চাপে এবং তলা থেকে আসা তাপ বিকিরণে
তরল অবস্থাতেই আছে। এবং এটা নিশ্চিত জল যেহেতু আছে প্রাণের সম্ভাবনাও
সেখানে বেশ ভাল। এখনও পর্যন্ত যে সব যান্ত্রিক রোবট মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে সেগুলি
কেবল মঙ্গলের আস্তরের সামান্য কিছু ভেতরে যেতে সক্ষম,সুতরাং এই মুহূর্তে আমাদের
এখানে জীবনের সন্ধান করা সম্ভব না। তবে নিকট ভবিষ্যতে মঙ্গলে পৃথিবী থেকে আরো অনেক
উন্নত যান্ত্রিক অভিযান যাবে যা মাটির অনেক গভীরে গিয়ে পয্য‾বেক্ষন
করতে সক্ষম হবে। ২০২০ সালের মধ্যে মঙ্গলে
প্রচুর অভিযান যাবে এবং গবেষণা চালান হবে। সুতরাং আশা করা যায় আগামি ১০ বছরের
মধ্যেই হয়ত এই বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত করে কিছু জানতে পারব।
মঙ্গলে জলের চিহ্ন
দ্বিতীয় যে জায়গা আমাদের নজর কাড়ে তা হল বৃহস্পতির একটি বড় উপগ্রহ ইউরোপা
(ইউরোপা কে খুব ছোটো দূরবীণের সাহায্যেও দেখা সম্ভব)। যা জানা গেছে ইউরোপার আস্তর
৫০০ মিটার থেকে ১ কিলোমিটার পর্যন্ত মোটা বরফে ঢাকা। কিন্তু এর তলায় আছে বহু
কিলোমিটার গভীর তরল জলের মহাসাগর। এই জল গ্রহের অভ্যন্তর থেকে তাপ পেয়ে খুব সামান্য পরিমানে
উষ্ণ যদিও তা খুবই শীতল। কিন্তু এতো শীতল নয় যাতে প্রাণ থাকতে পারে না। এমন অনেক
জায়গারই কথা জানা যাচ্ছে যা হয়ত এমনিতে খুব ই শীতল কিন্তু যেখানে প্রান থাকা
অসম্ভব নয়। ইউরোপার অভ্যন্তরে পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা
নাসার (NASA) আছে ভবিষ্যতে।
ইউরোপার উপরিতল
ইউরোপার অভ্যন্তর
আর একটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক জায়গা হোলো শনি গ্রহের একটি চাঁদ টাইটান।
টাইটানের উপরিভাগের সংগে পৃথিবীর উপরিভাগের আশ্চর্য মিল রয়েছে। এখানে রয়েছে শুধু
তরল নয়, একেবারে নদী ও হ্রদ। যদিও সে নদী
ও হ্রদ তরল মিথেন ও ইথেন দিয়ে তৈরি। এখানে আছে সক্রিয়
আগ্নেওগিরি। আছে এমন এক বাতাবরন যাতে নাকি পৃথিবীর বাতাবরনের মূল উপাদান
নাইট্রোজেন এ পরিপূর্ণ। এমন কোনো প্রাণী থাকা অসম্ভব না যেটা কিনা টাইটানে যা আছে
অর্থাৎ মিথেন, ইথেন, অ্যামোনিয়া ও জল (যা কিনা টাইটানের অভ্যন্তরে আছে) কোনো এক
বিচিত্র প্রাণের সূচনা করেছে। টাইটানে যাবার পরিকল্পনাও নাসার আছে তবে তা অন্তত
পক্ষে ১০ বছর পরের কথা।
টাইটানের লেক
এ ছাড়াও আছে শনির ছোট্টো উপগ্রহ এন্সেডেলাস। এন্সেডেলাস এর ব্যাস মাত্র
৫০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর ভেতর থেকে জাইসার এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে বরফ এবং লবন। এরও
অভ্যন্তরে আছে তরল জল।
এন্সেডেলাস
যদি আমরা শুধু প্রাণের মৌলিক উপাদান গুলির কথা ভাবি অর্থাৎ তরল জল, জৈব
পদার্থ ও প্রয়োজনীয় তাপ ও শক্তি তাহলে এই সৌরজগতে গ্রহ এবং উপগ্রহ মিলিয়ে এক ডজন
জায়গা পাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জল আছে এর আস্তরের নিচে। এই সব জায়গায়
নিদেন পক্ষে অণুজীব থাকা একেবারেই অসম্ভব নয়।
১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে বিজ্ঞানীরা প্রথম সৌরজগতের বাইরে একটি গ্রহের
উপস্থিতির প্রমান পান। এটি পেগাসাস তারামণ্ডলে অবস্থিত এবং এটি ৫১ পেগাসি তারার
চারদিকে ঘুরছে। এরপর থেকেই ক্রমশ দ্রুত গতিতে নতুন নতুন গ্রহের সন্ধান পাওয়া যেতে
থাকে। ২০০৯ সালে নাসা কেপলার নামক একটি মহাকাশ যান পাঠায় যেটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম
ভাবে আকাশের একটি বিশেষ অঞ্চলে বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহের খোঁজ করতে থাকে। সৌরজগতের
বাইরের গ্রহের খোঁজ কি করে পাওয়া যায় একটু বলি।গ্রহ থেকে আলো এত কম আসে যে তারার
বিশাল ঔজ্জল্যের জন্যে তাকে দূরবীনের সাহায্যে ধরা সক্ষম নয়, এর জন্যে অপ্রত্যক্ষ
উপায়ের সাহায্য নিতে হয়। গ্রহ যখন তারার চারপাশে ঘোরে তখন গ্রহের মহাকর্ষ টানের
ফলে তারাটি সামান্য দোলে। এছাড়াও যখন গ্রহটি তারাটির বিষুবরেখার কাছাকাছি দিয়ে যায়
তখন তারাটির ঐ গ্রহের জন্যে গ্রহন হয় (যেমন চাঁদ সূর্যের সামনে চলে এলে সূর্যগ্রহন
হয়)। তারার এই দোলাচলের হিসেব নিকেশ এবং গ্রহণের সময় তারার আলো
কতোটা কমছে সেই হিসেব করে বুঝতে পারা যায় গ্রহের ভর এবং আয়তন। তার থেকে সহজেই বার
করা যায় গ্রহের ঘনত্ব। এবং গ্রহের ঘনত্ব থেকে সেটি কি পদার্থ দিয়ে তৈরি সেটা সহজেই
হিসেব করে ফেলা যায়।
কেপলার পয্য‾বেক্ষনে
গ্রহনের সময় কম আলো (নিচের গ্রাফ এ) যার
থেকে গ্রহ সম্বন্ধে জানা যায়
প্রথম দিকে যে সমস্ত গ্রহ গুলির আবিষ্কার হয় সেগুলি অধিকাংশই বৃহস্পতির মত
বিশালকায় গ্যাসীয় গ্রহ। এগুলিতে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও এর উপগ্রহগুলিতে
প্রাণ থাকতে পারে। যত কারিগরি দক্ষতা বেড়েছে ও পয্য‾বেক্ষনের
সূক্ষ্মতা বেড়েছে ততই ক্ষুদ্রতর এবং এমন সব রকমের গ্রহ যা কিনা আমাদের কল্পনায়
আসেনি পাওয়া গেছে। প্রায় সম্পূর্ণ জল দিয়ে তৈরি বা ধাতু দিয়ে তৈরি, ধাতু ও জলের মিশ্রনে তৈরি সব রকমই পাওয়া গেছে। একটা কথা
মনে রাখতে হবে যে কম্পিউটার মডেলিং এর সাহায্যে একথা বোঝা গেছে যে একটি সূর্যের মত
তারার সৌরজগতে গড়ে ২-৫ টি গ্রহ পাথর ও জল দিয়ে তৈরি ( অর্থাৎ পৃথিবীর মত) এবং তার
মধ্যে ১০-২০ শতাংশ গ্রহ বাসোপোযুক্ত ( অর্থাৎ পৃথিবীতে যেমন প্রাণী আছে তাদের
বাসোপোযুক্ত) অবস্থানে রয়েছে। কোন তারার কত দূরে বাসোপোযুক্ত অবস্থান হবে তা
তারাটির ঔজ্জ্বল্য ও তাপমাত্রার ওপর
নির্ভর করে। এই বাসোপোযুক্ত অবস্থানকে অনেকে গোল্ডিলক জোন বলেন। কম্পিইউটার মডেলিং
আরো বলে যে পৃথিবীর মত গ্রহ যেখানে জল, পাথর ইত্যাদি আছে তেমন গ্রহের সংখ্যা বিরল
তো নয়ই বরং অত্যন্ত সুলভ।
এবার দেখা যাক কেপলারের পয্য‾বেক্ষন কি বলছে। জুলাই
২০১৩ অবধি কেপলার ১৩৪ টি প্রমানিত ও ৩২৭৭ টি এখনও পর্যন্ত অপ্রমানিত গ্রহের এবং ৭৬
টি অন্য সৌরজগতের সন্ধান দিয়েছহে। যদিও অপ্রমানিত গ্রহ গুলির প্রায় ৯০ শতাংশই
সত্যিকারের গ্রহ বলে প্রমাণিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে কেপলার আকাশের একটি অত্যন্ত
সীমাবদ্ধ এলাকায় তার সন্ধান চালিয়েছে। সবচেয়ে বড় খবর ১২০০ আলোবছর দূরে কেপলার ৬২ঈ
ও ৬২এফ নামক দুটি গ্রহের সন্ধান দিয়েছে যেগুলো খুব সম্ভব পৃথিবীর মতই জল ও পাথর
দিয়ে গঠিত এবং গোল্ডিলক জোনে রয়েছে অর্থাৎ বাসোপোযুক্ত। এমনকি এর থেকে যে
তারাটি দেখতে পাওয়া যায় সেটি বলতে গেলে আমাদের সূর্যেরই মত দেখতে লাগবে গ্রহটি
থেকে। এটিকে বিজ্ঞানিরা একটি বিরাট পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। সবচেয়ে বড় কথা কেপলার
থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা গেছে (এখনও পর্যন্ত করা গবেষণা থেকে) শুধুমাত্র আমাদের
নিজস্ব ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যলাক্সিতেই ১০০০০ কোটি পৃথিবীর মত গ্রহ পাওয়া যাবে
যা কিনা মানুষের মত প্রাণীর বসবাসের উপযোগী। এই বিশ্বে ৫০০০০ কোটির
বেশি গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে,সুতরাং প্রাণের উপযোগী গ্রহের সংখ্যা বলতে
গেলে অননুমেয়।
এখনও পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করেছি ও করছি জানতে পৃথিবীর মত গ্রহ ( উপাদান ও
তারার থেকে বাসোপযোগী দূরত্বে) আছে কিনা। এই প্রচেষ্টা আরো চলতে থাকবে। কিন্তু এতে
সত্যি সত্যি প্রাণ আছে কিনা আমরা জানব কি করে? এই গ্রহ গুলি এত দূরে ( বহু আলোক
বর্ষ দূরে) যে কোনো নিকট বা দূর ভবিষ্যতেও আমাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব না।
তবে যেটা করা যেতে পারে ও শীঘ্রই আমরা করব তা হল বিশাল বিশাল দূরবীক্ষণের সাহায্যে
এই গ্রহ থেকে আসা আলোকে বিশ্লেষন করে জানব যে প্রাণ থাকলে ওই সব গ্রহের বায়ুমন্ডলে যেসব উপাদান গুলি থাকার
কথা সেগুলি আমরা পাচ্ছি কিনা। এই সব উপদান
গুলি হল ওজোন, জল, অক্সিজেন, মিথেন ইত্যাদি। প্রাণ না থাকলে সাধারন বৈজ্ঞানিক
কারণে এই গুলি থাকার সম্ভাবনা, বিশেষতঃ একসঙ্গে, খুব কম ( মনে রাখতে হবে প্রাণ না
থাকলে অক্সিজেন ১০ লক্ষ্য বছরের মধ্যে বায়ুমন্ডল থেকে বিক্রিয়া করে নিঃশেষ হয়ে
যাবে)। সুতরাং এই গুলি বায়ুমণ্ডলে পাওয়া গেলে ধরে নিতে পারি যে
সেখানে প্রান আছে। এই জন্যে এখন চিলি তে ভি. এল. টি , অ্যারিজোনাতে এল. বি. টি
,যারা অত্যন্ত অল্প আলো সংগ্রহ করতে পারে এমন টেলিস্কোপ সবে তৈরি করা হয়েছে। এই
গুলি এবং জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ যা ২০১৮ সালে মহাকাশে পাঠানো হবে এই ধরনের গবেষণা
করবে। এর ফলে আশা করা যায় আগামি ১০ বছরের মধ্যে অন্য কোনো গ্রহ তে প্রাণ আছে কিনা
তার উত্তর আমরা পেয়ে যাব।
জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীন
তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে পৃথিবী ২.০ যখন পাওয়া যাবে তা কিন্তু পুরোপুরি
আমাদের মতন হবে না। দ্বিতীয়ত আমরা যদি ভাবি যে আমাদের পৃথিবীতে কোনো সমস্যা হলে
সেখানে আমরা বসবাস করতে, পারবো বা নেহাৎই বেড়াতে যেতে পারবো তা কিন্তু ভুল ধারনা।
কারন এগুলি কয়েক থেকে কয়েকশ বা তারো বেশি আলো বছর দূরে হবে এবং সেখানে যাবার জন্যে
যে বিজ্ঞান ও কারিগরির দরকার তা কবে আসবে এবং আদৌ আসবে কিনা আমরা জানিনা।
এতো গেল কত জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে তার একটা মোটামুটি হিসেব। কিন্তু
উন্নত মানের প্রাণী, যারা কিনা বুদ্ধিমান আমাদের মতন বা তার চেয়েও বেশি? সেটা আছে
কিনা কিম্বা থাকলে কত জায়গায় থাকতে পারে?
এর একটা আন্দাজ পেতে গেলে আমাদের পৃথিবীতে বুদ্ধিমান প্রাণী কত আছে তার
একটা ফর্দ করতে হয়। যদিও আমরা অণুজীব বা microbes দের বুদ্ধিমান প্রাণী
ভাবি না তাদের ক্ষমতা কিন্তু আমরা যা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি। অনূজীবরা বেশ উন্নত
জৈবিক কারখানা এবং এরা চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝতে পারে, ন্যানো ওয়্যার ( nano wires) তৈরি করতে সক্ষম,
এদের গোষ্ঠীগত ক্ষমতা আছে বায়ুমণ্ডল কে অনুভব করার এবং এরা অন্য অণূজীবের সঙ্গে
সখ্যতা পাতাতে পারে।
অণূজীবের কেরামতি
এবার নানারকম কীটেদের কথায় আসি। আমরা যাদের উই পোকা বলি তারা তাদের
নিজেদের মাপের তুলনায় বিশাল বড় আয়তনের কাঠামো তৈরি করতে পারে। আমরা যেগুলোকে উই
ঢিপি বলি সেগুলো সময় সময় এত বড় হয় যে যদি আমরা তুলনামূলক মাপের কথা ভাবি তাহলে
এগুলো উই এর মাপের তুলনায় উচ্চতায় মানুষের তৈরি স্কাই স্র্যাপারের চেয়ে উঁচু।
উই ঢিপি
অনেক কীটের তাদের নিজেদের একক বুদ্ধির বদলে চাকের কলোনিতে সমষ্টি গত ভাবে
বুদ্ধি ছড়িয়ে থাকে, এদের বেশ জটিল সামাজিক ব্যবহার আছে, এরা বিশেষ কিছু কাজে দক্ষ
এবং এরা রাসায়নিক ভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে।
সাধারন কীট
পোষা প্রাণী দের মধ্যে কাকাতুয়া পাখি জাতীয় প্রাণীর বেশ মজার ব্যক্তিত্ব দেখা
যায়, এরা কথা বলতে পারে এবং শূন্যের ধারণা করতে পারে। দেখা গেছে কাক কে একটি বোতলের
মধ্যে খাবার ও একটি তার জাতীয় কিছু রেখে দিলে সে সেই তার বেঁকিয়ে সেটাকে কাজে
লাগিয়ে খাবার তুলে নিতে সক্ষম। ইঁদুররাও বেশ জটিল। এরা যৌন সঙ্গম আঁচ করতে পারে,
এবং এরা নিজেদের চিন্তার সম্পর্কে ভাবতে পারে (meta cognition)।
ইঁদুর ও কাকাতুয়া
আর আছে এমন সব প্রাণী যাদের বুদ্ধির সম্বন্ধে আমাদের কোনো সম্যক ধারণা নেই
এবং যাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনা। যেমন সামুদ্রিক
প্রাণীগোষ্ঠী সেফালোপড (cephalopods উদাহরন অক্টোপাস)। এদের মস্তিস্ক শরীরের বিভিন্ন জায়গায়
ছড়িয়ে থাকে এবং এর একটা হাত কেটে বাদ দিলে সেটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবের মত আচরন
করে। এছাড়াও সমুদ্রে ডুবুরিরা অনেক সময় এদের অদ্ভুত কিছু ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছেন। এরা
পৃথিবীর মধ্যে থেকেও আমাদের কাছে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। অন্য গ্রহের প্রাণীর খবর
করতে গেলে এদের সম্মন্ধে আমাদের আরো অনেক জানতে হবে।
সেফালোপড
যদি দেহের ওজনের সঙ্গে মস্তিস্কের ওজনের তুলনা করি তাহলে আমরা যদিও
বিশিষ্ট কিন্তু অন্যান্য কিছু প্রাণীর চেয়ে দারুন কিছু আলাদা না।
বিভিন্ন প্রাণীর দেহ ও মস্তিস্কের ওজনের তূলনা
যেমন অর্কা নামক ডলফিন যাদের killer whale বা খুনি তিমিও
বলা হয়। এদের
কোনো স্বাভাবিক শত্রু নেই (মানুষ ছাড়া), মস্তিস্ক দেহের তুলনায় মানুষের মত বড় এবং
জটিল, বেশ দুরুহ ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে, নিজেদের সংসার এবং সমাজ আছে,
নিজেদের ছেলেমেয়েদের লালন পালন করে (মানুষ ঠিক যতটা বয়েস অবধি করে এদের আয়ুর
অনুপাতে ঠিক ততটা অবধি), বিবাহের মত একজনকে সারা জীবনের সাথী করে ইত্যাদি। এদের
গাড়ি, বোমা, সেল ফোন বা ইন্টারনেট নেই তার একমাত্র কারণ বোধহয় এদের আঙ্গুল নেই এবং
এতে এদের কোনো ক্ষতিও নেই কিন্তু এরা এদের পরিবেশের সঙ্গে অসাধারণ ভালো ভাবে
নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।
অর্কা
আমরা যদি প্রাণীর বুদ্ধি বিকাশের হার দেখি তাহলে তা অত্যন্ত দ্রুততার
সঙ্গে ঘটেছে গত ২০ লক্ষ্য বছরে এবং বিশেষত গত ১ লক্ষ্য বছরে। দেহের ওজনের তুলনায়
মস্তিস্কের ওজনের বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে মানুষ জাতীয় প্রাণীর
মস্তিস্কের তুলনামুলক ওজন বৃদ্ধি খুব সাম্প্রতিক ঘটনা এবং বিগত ৫ কোটি বছরের মধ্যে
অন্য জগতের প্রাণী এখানে এলে বুদ্ধিমান প্রাণী বলতে তিমি এবং ডলফিনদেরি ( বা তাদের
পূর্বপুরুষ ) দেখতে পেত।
মস্তিস্কের বিকাশের হার
প্রাণ কত রকম বিভিন্ন হতে পারে তার একটা হিসেব করা যাক। প্রথমত প্রাথমিক
কোষ বা সেল গুলি অনেক বিভিন্ন হতে পারে। দ্বিতীয়ত আমরা সাধারানত যে জিনের প্রাকৃতিক
বাছাই ও পরিবর্তন (natural
selection and mutation) ধীর গতিতে দেখতে পাই তার বদলে জিন বিনিময়ের (gene
swapping) ফলে অনেক দ্রুততর গতিতে জীবনের পরিবর্তন সম্ভব। তৃতীয়ত প্রাণ যা করে তার
জন্যে প্রথাগত সেল বা কোষের প্রয়োজন নাও হতে পারে। প্রাণীর কোষ নয় এমন কিছু
পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাণীর মত আচরন করতে সক্ষম। খুব ক্ষুদ্র
জৈবিক কণা সারা গ্রহে ছড়িয়ে থাকা ভু-প্রযুক্তিতে ( geo engineering) প্রাণীর কাজ করতে
পারে।এছাড়া ডি. এন. এর মূল বা জেনেটিক কোডে পরিবর্তন করে অন্য জাতীয় প্রাণের
সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি আমরা প্রাণ বলতে যা জানি অর্থাৎ ডি.এন. এ ,আর. এন. এ ও
প্রোটিন এর বাইরেও প্রাণ হতে পারে যা আমরা জানিনা। আমাদের জেনেটিক কোডে বেশ কয়েকটি
ডিভিডি এর সমান তথ্য লেখা থাকে কিন্তু জৈব রসায়নের মৌলিক নীতি অনুযায়ী এর চেয়ে
বেশি তথ্য ঢোকানো যেতে পারে যা অনেক দ্রুততর বিবর্তনের সূত্রপাত করতে পারে। এমন
কোনো প্রাণ হতে পারে যা হয়ত কার্বন ও জল ছাড়াই উদ্ভূত হতে পারে। এবং পরিশেষে এমন
প্রাণ থাকতে পারে যা আমরা প্রাণ বলে বুঝতে পারবো না।
গ্রহান্তরে
সম্ভাব্য প্রানের রকমফের
আমাদের জীবনের সূচনা ৩৬০ কোটি বছর আগে হলেও তথ্যের বিস্তারের ইতিহাস এরকম - মানুষের জন্ম (কয়েক লক্ষ বছর), সভ্যতার বিস্তার
বই এর উদ্ভাবন (কয়েক হাজার বছর ) এবং পরিশেষে গত কয়েক দশকে কম্পিউটার ও
ইন্টারনেটের উদ্ভাবন যা তথ্যের প্রচার জীবনের শুরুতে যা ছিল তার ১০১৯ গুন
করে দিয়েছে। আমি আগেই বলেছি আর ২০-৩০ বছরের মধ্যে কম্পিউটার ও রোবটের বুদ্ধি
মানুষের তুলনীয় হয়ে যাবে এবং আমরা অন্য গ্রহে নিজেরা না যেতে পারলেও এই সব রোবট কে
পাঠাতে পারব এবং যদি আমরা রিলেটিভিটি তত্ত্বের বেগের গতিবেগের ওপর নিষেধাজ্ঞা
মেনেও আলোর গতির এক দশমাংশ গতিতে বিভিন্ন গ্রহে যাই তাহলে আমাদের পুরো ছায়াপথে
উপনিবেশ গড়তে ১.৫ কোটি বছর লাগবে।
রোবটের সাহায্যে এই গ্যালাক্সিতে উপনিবেশ স্থাপন
১৯৫০ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এনরিকো ফারমি একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন। আমাদের সভ্যতা এখনও খুব স্বল্পবয়স্ক
এবং আমাদের সভ্যতা ও প্রযুক্তির স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলেই আর অল্প কিছু
দিনের মধ্যে অন্য গ্রহে পাড়ি দেব। তিনি অনুমেয় অসংখ্য বসবাস যোগ্য জায়গার কথা ভেবে
বলেছিলেন যে এমন হওয়া খুবই সম্ভব যে এমন গ্রহ আছে যা ঠিক আরেকটি পৃথিবীর মত কিন্তু
যা পৃথিবীর চেয়ে ৬ কোটি বছর আগে জন্মেছে। সুতরাং সেখানকার প্রাণী স্বাভাবিক নিয়মে
এতটাই এগিয়ে আছে যে আমরা তাদের কাছে খুব নিম্ন ধরনের আ্যনারোবিক ব্যাক্টিরিয়ার
সমান।
এনরিকো ফারমি
ফারমির কথার নানারকম উত্তর হতে পারে। ১) আমরা একক। আর কোথাও সভ্য ও
প্রযুক্তিতে উন্নত প্রাণ নেই, আমাদের সভতা এক আকস্মিক ঘটনা।২) এরকম সভ্য প্রাণী
খুব বিরল এবং আমরা স্থান ও কালের দ্বারা একের অন্যের থেকে বহু বহু দূরে। এই
মহাবিশ্ব অত্যন্ত বড় জায়গা, এমনকি আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সিও খুব বড় জায়গা। ৩)
তারা আছে কিন্তু আমাদের তাদের চিনতে পারার ক্ষমতা নেই। ৪) তারা আছে এবং তারা এতটাই
উন্নত যে তারা আমাদের অত্যন্ত তুচ্ছ ভাবে ও আমাদের সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই। পরিশেষে
এও হতে পারে যে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি করেছে আদপে বাইরের কোনো সভ্য প্রাণী।
আমাদের সঙ্গে অন্য জগতের প্রাণীর যোগাযোগ কি ভাবে হবে বা হতে পারে? মনে
হয়না আমরা তাদের লুচি মণ্ডা মিঠাই দিয়ে আমন্ত্রন করতে পারবো। একটা অদ্ভুত সম্ভাবনা
হচ্ছে তারা এখনি আমাদের মধ্যে আছে কিন্তু তাদের আমরা চিনতে পারছি না। এটা যদি
সত্যি হয় তা হলে যুক্তি অনুযায়ী আপনি বা আমিও অন্য গ্রহ থেকে এসে থাকতে পারি।
কিন্তু যদি এটাকে একটু উড়িয়ে দিই তাহলে আমরা কি পাই? এই ছায়াপথে আমাদের মত বা
ততধিক সভ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নত প্রাণীর সম্ভাবনা হিসেব করতে ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক নামে
এক বিজ্ঞানী একটি সহজ সমীকরনের (Drake equation) আবিস্কার করেছেন। এটিকে লিখলে দাঁড়ায়
N= আমাদের গ্যালাক্স্যিতে উন্নত সভ্যতার সংখ্যা যার সঙ্গে
আমাদের যোগাযোগ সম্ভব
R*= আমাদের গ্যালাক্সিতে বাৎসরিক গড়পড়তা তারার সংখ্যা
fp= এই তারা গুলির মধ্যে যে ভগ্নাংশে গ্রহ আছে
ne= গ্রহ সম্বলিত তারা গুলির মধ্যে যে ভগ্নাংশে প্রাণ থাকা সম্ভব
fl= প্রাণ থাকতে পারে
এমন গ্রহগুলির যে ভগ্নাংশে বাস্তবিক প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে
fi= প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এমন গ্রহগুলির মধ্যে যে ভগ্নাংশে সভ্য
উন্নত প্রাণ তৈরি হয়েছে
fc= সেইসব সভ্যতা গুলির যে ভগ্নাংশ এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছে
যাতে তাদের পাঠানো সংকেত ধরা যেতে পারে
L= যে সময় ধরে এই সংকেত এই সভ্যতাগুলি পাঠাচ্ছে
এই সমীকরণ সহজবোধ্য এবং এটি ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকা একটি সংখ্যা। কেবল
শেষ অংশ এল নিয়ে একটু বলি। এমন হতে পারে যে বিভিন্ন কারনে এই সব উন্নত সভ্যতা হয়ত
কিছু দিনের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ( যেমন পারমানবিক বোমা বা গ্রহের
তাপমাত্রার বিশেষ পরিবর্তন গ্রীন হাউস গ্যাসের জন্যে)। সুতরাং সভ্য প্রাণী উদ্ভূত
হলেও তা কত দিন ধরে টিকে থেকে এই সব সংকেত পাঠাবে তা অনুমানের বিষয়। এই সমীকরণের
প্রথম তিনটি সংখ্যা বিজ্ঞানের সাহায্যে খুব শীঘ্রই নির্ণীত হবে বা ইতঃপুর্বে
নির্ধারিত হয়েছে। বাকি সংখ্যা গুলি নির্ধারণ এখনও পুরোপুরি ব্যক্তিগত অনুমান
ভিত্তিক।
ড্রেক সমীকরণ
মানুষ যেসব মহাকাশ যান পাঠিয়েছে তার মধ্যে পায়োনীয়ার ১০ এ বোতলের মধ্যে
রাখা মানব জাতির সম্বন্ধে তথ্য সম্বলিত কিছু চিহ্ন ও ভয়েজারে একটি গ্রামোফোন রেকর্ড পাঠানো হয়েছে
আমাদের সভ্যতা ও বুদ্ধির নিদর্শন স্বরূপ। এই দুটিই এখন সৌরোজগত ছাড়িয়ে মহাশুন্যে
পাড়ি দিয়েছে এবং কোনো দিন হয়ত অন্য কোনো সভ্যতার হাতে পৌঁছে যাবে।
পায়োনীয়ার এ পাঠানো ছবি
ভয়েজারে পাঠানো রেকর্ড
বাইরের জগত থেকে আসা সঙ্কেত ধরার জন্যে একটি বিশেষ কায্য‾ক্রম
গত ৫০ বছর ধরে চলছে যার নাম সেটি (SETI or Search For Extraterrestrial Intelligence)। এতে বহির্জগত থেকে
আসা রেডিও সঙ্কেত ও অপটিক্যাল পালস লেসার সঙ্কেত ধরার ব্যবস্থা রয়েছে ও সঙ্কেত
পাঠানো হচ্ছে। যদিও গত ৫০ বছরে কোনো উল্লেখযোগ্য সঙ্কেত আমরা পাইনি কিন্তু
আগামী ২০ বছরের মধ্যে এই গবেষণা অত্যন্ত উত্তেজক হতে চলেছে কারন ততদিনে আমরা আমাদের
থেকে ৩০০০ আলোবছর দূরত্বের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি তারার গ্রহ থেকে আসা কোনো সঙ্কেত
ধরে ফেলতে পারব এবং তারা আমাদের সঙ্কেত ধরতে পারবে। সুতরাং এখনকার
অনেকেরি জীবৎকালের মধ্যে বাইরের সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে
এই বিষয়ে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে আমরা যে সভ্যতা ধরতে পারব তারা আমাদের সভ্যতার
ভীষণ কাছাকাছি হবে এই কারনে যে আমরা আর কিছুদিনের মধ্যেই এত উন্নত হয়ে যাব যে তখন
আর আমরা রেডিও সঙ্কেত বা লেসার পালস ব্যবহার করব না।
সেটি
বাইরের সভ্যতার সঙ্গে আমাদের যে সুখের হবে তার অবশ্য কোনো নিশ্চয়তা নেই
তার কারন ১) তারা আমাদের অবজ্ঞা করতে পারে, ২) তারা আমাদের তাদের শিকার বা খাবার
হিসেবে ভাবতে পারে ও আক্রমন করতে পারে।
এই প্রবন্ধ শেষ করব একটি উদাহরন
দিয়ে। আমরা যত গ্রহ কেপলারের সাহায্যে জানতে পেরেছি তার সংখ্যা আমাদের একটি
আঙ্গুলের সামনে এক চিমটে বালুকনার সমান।এই সংখ্যা ৩০০০ এর মত। আগেই বলেছি যে
আমাদের গ্যালাক্সিতেই ১০০০০ কোটি বসবাস যোগ্য গ্রহের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখন যদি
পুরো দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের ৫০০০০ কোটির বেশি গ্যলাক্সির কথা ভাবি তাহলে বাসযোগ্য
গ্রহের সংখ্যা আমাদের দীঘায় বসে যে সমুদ্রসৈকত দেখতে পাই তাতে যত বালুকনা আছে তার
সমান বা বেশি। এখন এর মধ্যে কত গ্রহে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এবং সেই প্রাণ আমাদের
এই সভ্যতার মত উন্নত হয়ে অন্য জগতের প্রাণের সন্ধান চালাচ্ছে তার সংখ্যাটা আপনি
নিজেই মনে মনে ভেবে আন্দাজ করে নিন।
যে কটি গ্রহ কেপলার দেখেছে
যে কটি গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে